Monday, July 03, 2006

গ-ল-প


যা চিরাচরিত, তাকে চিরে দেখা একসময় খুব হুজুক ছিল৷ এখন সেই হুজুক বা হিড়িক কোনটাই নেই বটে; কিন্তু সেই গল্পটা এখনও অক্ষত আছে ৷ কিন্তু সেই গল্পটা বলতে গিয়ে মুশকিল দেখা দিল, অন্তত আমার৷ চার-পাঁচবার ঢোক গিললাম ৷ ঘরের আলো দু'বার নেভালাম আর তিনবার জ্বাললাম ৷ মেঘের মত ফুরফুরে এয়ার কন্ডিশন আরও দু'ডিগ্রি নিচে ঠেলে দিলাম ৷ আমি শত ভেবেও মনে করতে পারলাম না গ, ল, প এর মধ্যে সবাই ছেলে ছিল কি না ৷ প যেহেতু 'ল' কে কাঁধে করে নদীটা পেরিয়েছিল, তাই দৃশ্যত 'প' কিঞ্চিত্ বলশালী, পুরুষ হওয়া স্বাভাবিক ৷ কিঞ্চিত্ উত্সুক বোধ করলাম, আচ্ছা 'ল' কী নারী? রাত্রে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ফাটাফাটি স্বপ্ন দেখলাম ৷ আমি ঐশ্বর্য রাইকে কাঁধে করে নদী পার করছি ৷ অত:পর আখ্যান আরম্ভ ৷


ঐশ্বর্যকে আমি কোথায় প্রথম দেখি ঠিক মনে নেই ৷ ওর জন্যে আমার মনে একটু দুর্বলতা ছিল ৷ খবরের কাগজে ওর ছবি বেরোলে আমার বুকের মধ্যে ঢিপিস ঢিপিস হত ফিল্মি কায়দায় ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ডের মতো ৷ অন্য ঘ্যাম কোন ছবি দেখলেও ঢিপি ঢিপিস হতো, কিন্তু পূর্বোক্ত ঢিপিস ঢিপিস ছিল একেবারে অন্যস্বাদের ৷ সে আমি তোমাদের বোঝাতে পারবো না ৷ কেবল আমার যে বেষ্টফ্রেন্ড ( ধরা যাক তার নাম 'গ' ) তাকে বলেছিলাম ৷ ব্যাটা একটা গাধা ৷ বলে কিনা ডাক্তার দেখা ৷


আমি জানতাম এর চিকিতসা একমাত্র ঐশ্বর্যই করতে পারে ৷ আমি ওকে নিয়মিত চিঠি লিখতাম যদিও ঐশ্বর্যের কাছ থেকে আমি কোন উত্তর পেতাম না ৷ গাধাটা বলত, এসব প্লেটোনিক প্রেম ছাড় ৷ ভাল স্যাটি মেয়ে দেখে প্রপোজ কর দেখি ৷ এমনও হয়েছে 'তাল' বলে একটা সিনেমা চলছিল তখন, পরপর চারটে শোতে ঐশ্বর্যের সঙ্গে কথা বলছি ৷ তারপরও হলে বসে আছি দেখে মালিকপক্ষের লোক ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে ৷ বাইরে হ্যাভক বৃষ্টি পড়ছিল, সারা রাত্তির প্যাচার মত ভিজলাম ৷ তখনই আমি ডিসিশন নিয়ে নিই, এবার নিজের রক্ত দিয়ে ঐশ্বর্যকে চিঠি লিখব ৷ রিপ্লাই না পেলে, এই শর্মা আর জীবনটাই রাখবে না ৷


আল্টিমেটলি অবশ্য চিঠিটা লেখা হয়েছিল গাধাটার বুদ্ধি দিয়ে, মুর্গীএর রক্তে ৷ আমার আলটিমেটাম জানিয়ে দিই ৷ সেই চিঠি ঐশ্বর্যকে পাঠিয়েছিলাম বিয়ারিং করে ৷ মাইরি বলছি সেই সময় আমার কাছে কোন পয়সা ছিল না ৷ আসলে পকেটে পয়সা থাকার কোন সিনই ছিল না ৷ হলে 'তাল' চলছিল ৷ পকেটে পয়সা থাকলে আমি হলের বাইরে থাকার মত বোকা নই ৷ আমি আমার বন্ধুটার মত গাধা নই ৷ ও তো যাকে পারতো তার সন্গে লাইন মারতো ৷ আমি ওর বেষ্টফ্রেন্ড হওয়ায়, ও অবশ্য আমাকে সব কথাই বলত ৷ ওর কোন ক্লাস-ফ্লাসের বালাই ছিল না, খালি ছুক-ছুক ৷ ঐ অনেকটা তোমাদের কার্ল মার্কসের মত ৷ আস্থা খালি 'মোড অফ প্রডাকশনে' ৷ চিঠিটা পাঠিয়েও আমার শান্তিতে থাকার জো ছিল না ৷ রাত্রে ঘুমাতে পারতাম না ৷ কেবল মনে হত, যদি ঐশ্বর্য টের পেয়ে যায়, ওটা মুর্গীর রক্তে লেখা ৷ আমার খুব ভয় করত ৷ রাতে ভাল করে ঘুমোতে পারতাম না ৷ আমার আবার ঘুম না হলে স্বপ্ন-ফপ্ন আসে না, মানে ধাতে নেই আর কী ! স্বপ্ন না দেখতে দেখতে আমি ক্রমশ ঐশ্বর্য এর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকলাম ৷


আমার স্বস্তিতে থাকার যো নেই ৷ আমার গাধা বন্ধুটার সাথে গন্গার ঘাটে যেতাম বটে, কিন্তু ওর সন্গে শান্তিতে দুটো কথা বলার যো ছিল না ৷ ও দিব্যি লাইন মেরে যেত আর আমি খানিকটা তফাতে বসে ঘাস ছিড়তাম আর পিঁপড়ের বাসা ভাঙতাম ৷ গন্গার দিকে আমি তাকাতাম না, ইনফ্যাক্ট আমার বেশ ভয় করত ৷ স্বপ্নে আমি এখান থেকেই ঐশ্বর্যকে কাঁধে করে নদী পার করেছিলাম ৷ ভাগ্যিস স্বপ্ন কখনও সত্যি হয় না ৷ নিজেই শালা সাঁতার জানি না, আবার অন্যকে পার করা ৷ প্রেস্টিজ পুরো ফেটে হাতে ৷ স্বপ্ন আর বাস্তবে অনেক ফারাক ৷ ঐশ্বর্য এই ঘাটে এসে দাঁড়ালে , মা কালীর দিব্যি, মিনিমান এককোটি লোক এসে গন্গার ঘাটে এসে জড়ো হয়ে যাবে ৷ স্বপ্নে তো গাধাটাকে ছাড়া আর কাউকে দেখিনি ! মনটাকে টেম্পোরারি বুঝ দিলাম, এই গ-ল আর প নিয়ে যত গল্পই থাক, রিয়ালিটিতে ডিফারেন্স আছে ৷ গাধাটার কাজই ছিল আমাকে উপদেশ দেওয়া, বলল, এই ডিফারেন্সটা বোঝার জন্যে নাকি আমার দেরিদা পড়া উচিত ৷


লাইব্রেরী থেকে বই গেঁড়িয়ে পড়া শুরু করে দিলাম ৷ ইংরাজী আমার ধাতে সয় না, কিন্তু এই বইটা দিব্যি লাগতে লাগলো ৷ লোকটাকে আমার বন্ধু মনে হলো ৷ ল্যাং খেলে এই ধরনের অনেক লেখা মাথায় আসে ৷ মাথা নেই, মুন্ডু নেই, লিখলেই হল ৷ নতুন থিওরি দিচ্ছি ৷ বই-এর পিছনে উত্তর মিলিয়ে কেউ খচাত করে কাটতে পারবে না ৷ দেখলাম, ফিলজফার হওয়াটাই বেশ ৷ ব্যাপারটা মাথার মধ্যে তিনদিন ধরে ঘুরপাক খেল ৷ আল্টিমেটলি শেপ নিল এক মাঝরাত্তিরে ৷ লোকনাথের ক্যালেন্ডারটার পেছনের জমিতে নামিয়ে ফেললাম ৷ গ-ল আর প কে নিয়ে আদতে কোন গল্পই হতে পারে না ৷ আগে অনেক ত্রিকোণ প্রেমের গল্প ফেঁদেছো, তখন এই শর্মা আসেনি বলে রক্ষা পেয়েছো ৷ আমি থাকলে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দিতাম ৷ বাইনারি থিয়োরি ঝেড়ে দেখলাম, মূল চরিত্র দুটো ৷ নিউট্রনটা বাড়তি, আসল হল পজিট্রন আর ইলেকট্রন ৷ সেটাকে এক্সপ্লেন করলাম ফ্রয়েড ঝেড়ে একই চরিত্রে নারী ও পুরুষের লক্ষণ কিভাবে থাকে ... ..৷


আমার থিসিসটা গাধাটাকে ডেকে শোনালাম ৷ 'গ-ল-প' -এর শেষটা শুনে ও হ্যাভক খচে গেল ৷ বললো, তোর পেট গরম হয়েছে, গন্গর হাওয়া খাবি চ ৷ আমি রাজি হলাম না ৷ 'মাইরি বলছি, সত্যি কথাটাই ওকে বললাম, গন্গা দেখলে আমার ভয় করে ৷ গাধাটা 'হাইড্রোফোবিয়া' ,না 'হাইড্রোসিল' কী সব বিড়বিড় করতে করতে হাওয়া হয়ে গেল ৷


এবার সুনীল গান্গুলিকে ষ্ট্রেটকাট একটা চিঠি লিখে ফেললাম, জানিয়ে দিলাম, বাংলা বর্ণমালায় 'গ-ল-প' তিনটে অক্ষর ফালতু রাখার কোন মানে হয় না ৷ 'প'টাকে হটিয়ে দেওয়ার জন্যে বাইশখানা গোলা গোলা জুক্তি দিয়েছিলাম ( আসলে 'ল' তে ল্যাংচা, লজেন্স, লরি সব হেভি হেবি জিনিস, 'প'তে পেঁদানি, পড়াশোনা সব খারাপ খারাপ ওয়ার্ড; এগুলো আমি অবশ্য ডিরেক্টলি ম্যানিফেষ্টোতে লিখিনি) ৷ একমাস ওয়েট করলাম, মালটার কাছ থেকে কোন রিপ্লায় এলো না ৷ মনে হল, ম্যানিফেষ্টো পড়ে সুনীল গান্গুলি ট্যান হয়ে গেছে ৷ আবার ভয়ও করতে লাগলো, পুরো কনসেপ্টটাই না আবার নেতাজী করে দেয় ৷ চুপিচুপি মুর্গীর রক্ত যোগাড় করে সুনীল গান্গুলিকে একটা হুমকি চিঠি লিখে ফেললাম ৷ বরকতদের মত এই শর্মাও শহীদ হবে বাংলা ভাষার জন্য ৷


তিনমাস কেটে গেল ৷ নো রিপ্লাই ৷ বুঝলাম ব্যাটা আমাকে ভয় পাচ্ছে ৷ চেপে যেতে চায় ৷ আমি আমার ক্ষমতা সম্পর্কে এবার নি:সন্দেহ হলাম, এন্থু ও বেড়ে গেল ৷ রবীন্দ্র সদন- নন্দন চত্তরে চর্কি শুরু করে দিলাম ৷ চারটে লিটল ম্যাগে আমার লেখা কবিতা বেরিয়ে গেল ৷ ( কবিতা না ছাই, আমার ম্যানিফেষ্টোর ছ'টা / আটটা করে লাইন ছাপিয়ে নিচ্ছি এই সুযোগে) ৷ বোল্ডার ঘোষ নামের এক মানবীর ফ্যানমেল এলো ঝাড়গ্রাম থেকে ৷ গুরু গুরু ৷


জনৈক সাহিত্যিকের স্মরণসভায় সবাই দেখলাম নিজের গল্প-কবিতা দিব্যি পড়ে চলে যাচ্ছে ৷ আমিও পকেট থেকে ভাঁজ করা ক্যালেন্ডারটা খুলে একসময় পড়তে শুরু করি ৷ কবিদের মতো গলায় ঢেউ খেলিয়ে খেলিয়ে দিব্যি পড়ছিলাম ৷ জনৈক পাঠিকা, সম্ভবত ঐ সাহিত্যিকের যুবতী স্ত্রী ( তিন নম্বর বা চার নম্বর নিশ্চয়ই) সদ্য বিধবা হঠাত চেঁচিয়ে উঠলেন , এই সব ' গাল-গল্প' বন্ধ করুন ৷ বুঝতে পারলাম আমার লেখা তার পুরোটাই ট্যান হয়ে গেছে ৷ মুচকি হেসে বললাম, ওসব পুরনো 'গল্প' ভুলে যান, দাদারা গল্পের শাঁস-আঁটি সবই খেয়ে ফেলেছেন, এখন শুধু 'গাল'টুকু পড়ে আছে ৷ ঝাড়ি মেরে দেখলাম, তার ফর্সা গালটা স্যাট করে লাল হয়ে গেল ৷ বুকের মধ্যে টের পাচ্ছি সেই ঢিপিস ঢিপিস, যেন ডাইনোসরে ডন দিচ্ছে ৷ 'প্রেম'এ পড়লাম নাকি? না: 'প' টাও ইম্পর্টেন্ট মনে হচ্ছে ৷ প্রেমে, প্লেনে আর প্লেগেও রক্ষা করো বাবা লোকনাথ, তোমার সার্ভিস আরেকটু এক্সটেন্ড করে দাও বাবা ৷



প্রথম প্রকাশ : ছায়াবৃত্ত, বর্ষ ১, সংখ্যা ৯, অক্টোবর ২০০৪

No comments: