Tuesday, June 20, 2006

সিস্টেমান্তর


এলাকা জুড়ে ডাইনোসরদের মধ্যে মড়ক দেখা দিলো ৷ অল্প বয়সেই সবাই বুড়ো হয়ে যেতে লাগলো ৷ আর বুড়ো হতে না হতেই সমস্ত দাঁত পড়ে যেত ৷ তখন তারা খাবার খেতে পারতো না- বলা ভালো- খাদ্য সংস্থান করতে পারতো না ৷ ডাইনোসরেরা মহাসাগরের পার থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে সেটার খোলটা প্রথমে দাঁত দিয়ে কড়মড় করে ভাঙতো তারপর ভেতরে যে ইয়া বড় বড় মুক্তো থাকতো সেগুলো সারাদিন ধরে চুষে চুষে খেত ৷ ফলে দাঁত পড়ে যাওয়ায় ঝিনুক ভেঙে মুক্তো খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল ৷


ডাইনোসরেরা দৌড়ালো ডেন্টিষ্টের কাছে ৷ ডেন্টিষ্ট ডাইনোদের শরীরের সঙ্গে মানানসই ইয়া লম্বা লম্বা দাঁত ফিট করতে গেল ৷ কিন্তু বিপদ এল যখন ডাইনোসরেরা বেঁকে বসল ৷ বললো, আমাদের ছোট্ট ছোট্ট দাঁত দাও ৷ বড় দাঁত আমাদের একঘেয়ে হয়ে গেছে ৷ পেছন থেকে অন্য ডাইনোসরেরা চীত্কার করে উঠলো , উল্টে দাও, পাল্টে দাও ৷ ডাক্তার বললো, তোমরা ছোট্ট ছোট্ট দাঁত নিয়ে কি করবে ? ঝিনুক তো ভাঙতে পারবে না ৷ তখন ডাইনোসরেরা বললো, তাহলে মানুষের মত দাঁত দাও ৷ ডাক্তার ভাবলো, মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী: ওদের দাঁত দিয়ে দিলে ডাইনোদের দাঁতের বুদ্ধি খুলে যাবে ৷ ফলে ঝিনুক ছেড়ে কোপ্তা কোর্মা খাবে ৷ তখন স্বাভাবিক খাদ্য শৃঙ্খলে টান পড়বে ৷ মুখে বললো, মানুষের দাঁত ? ঐ দাঁত পড়লে কিন্তু সারাদিন মানুষের মত বকবক করবে ৷ ডাইনোসরেরা সমস্বরে বললো না না ঐ দাঁত চাই না ৷ আমাদের নিজেদের দাঁত ফিরিয়ে দাও ৷ ডাক্তার পড়লো বিপদে ৷ তার কাছে ডাইনোসরের দাঁত ছিলো না ৷ সে বললো, দাঁত একবার গেলে আর ফিরে পাওয়া যায় না ৷ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝতে হয় ৷


এদিকে বুড়ো ডাইনোসরদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে লাগলো ৷ সরকার ভয় পেয়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনে দশ দফা কর্মসূচী নিয়ে এলো ৷ কেন না , সরকার সেই বছরই ওল্ড সিটিজেনদের সুবিধা দানের জন্যে বিশ দফা কর্মসূচীর প্রস্তাব করেছিল ৷ সরকার এখন দেখল বয়স্ক নাগরিকদের সুবিধাদানের কর্মসূচী বাস্তবায়িত করা অসম্ভব ৷ ট্যাকশাল এমনিতেই শূণ্য ৷ ফলে দপ্তরে দপ্তরে সার্কুলার পাঠালো, জনসংখ্যা বাড়াও ৷ ছোটদের যোগান বাড়লে তবেই বুড়োদের চাহিদা প্রশমিত হবে ৷ নির্দেশ জারী হল ৷ আওয়াজ উঠলো- প্রতি ঘরে দশটি শিশু ৷ কেউ রবীন্দ্রনাথ কেউ যীশু ৷৷ ঘোষণা করা হল, প্রতি পাঁচ বছরে সর্বাধিক উত্পাদনকারী দম্পতি কে ধৃতরাষ্ট্র পুরস্কার দেওয়া হবে ৷ দশের বেশি সন্তান থাকলে মা-বাবাকে কেবিসি তে সরাসরি প্রতিদ্বন্দিতা করার সুযোগ দেওয়া হবে ৷


ছোট ডাইনোসরদের মধ্যে হইচই পড়ে গেল ৷ তাদেরকে সর্বত্র গুরুত্ব দেওয়া শুরু হল ৷ সরকার থেকে ভোটাধিকারের বয়স কমিয়ে দেওয়া হল ৷ ষ্টার টিভি জুনিয়ার কেবিসি চালু করে দিল ৷ বুড়োদের পরিবর্তে ছোটদের মীমাংসার রায়ই অঞ্চলের সবাই মেনে নিতে লাগলো ৷ ছোট ডাইনোসরেরা ঝিনুক ভেঙে দিত অর বুড়োরা মুক্তো চুষে চুষে খেত ৷ ফলে বুড়োরা ক্রমশ অলস ও অকর্মণ্য হয়ে পড়তে লাগলো ৷ তারা শুধু বসে বসে ছোটদের সমালোচনা করত ৷ ছোটরা রোজ নিন্দে শুনতে শুনতে একদিন বলে উঠল, ধ্যাত্তেরিকা ৷ তারা লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দিল ৷ তাদের অন্য একটা ইস্যু ও ছিল ৷ তাদের মধ্যে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বিপদজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছিল ৷ মানবাধিকার কমিশন থেকে সরকারকে নোটিশ পাঠানো হল ৷


বুড়ো ডাইনোসররা পড়ল বিপদে, তারাও সরকারের কাছে দরবার শুরু করলো ৷ খাদ্য দপ্তরে গিয়ে বললো, রেশনে মুক্তো দেওয়া যেতেই পারে শুধু একটু অসুবিধা আছে ৷ পাইল করার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ ঝুটা মুক্তো যতদিন না আমরা তৈরী করতে পারছি ততদিন আপনাদের না খেয়ে থাকতে হবে ৷ ডাইনোসরেরা বললো, তা কি করে সম্ভব ! খাদ্য মন্ত্রক বললো, আমাদের কিছু করার নেই ৷ রেশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে গেলে আগমার্ক থাকতেই হবে ৷ ভেজাল না থাকলে আগছাপ পড়বে না ৷ ডাইনোসরেরা বললো, তা বলে না খেয়ে থাকতে পারবো না ৷ আপনারা ভেজাল মেশান ৷ খাদ্যদপ্তর খুশিই হল, আপনারা এক্ষুনি তথ্য প্রযুক্তি দপ্তরে খোঁজ নিন ভেজাল মুক্তো কোথায় তৈরী হচ্ছে ৷


ডাইনোসরেরা গেল তথ্য ও প্রযুক্তির দপ্তরে ৷ তথ্য প্রযুক্তি দপ্তর ইন্টারনেটে অনেক ঘেঁটে ঘুটে বলল, আমেরিকার গান্ধী মেমোরিয়াল ল্যাবে নকল মুক্তো তৈরী হচ্ছে বটে কিন্তু খাদ্য দপ্তরের যে পরিমাণে দরকার তাতে ঐ ল্যাবের দশ বছর লেগে যাবে ৷ এই রকম দশ খানা ল্যাবে যদি বানানো যায় তবে এক বছর লাগবে ৷ একশো খানা ল্যাবে বানাতে পারলে মাস খানেক আপনাদের না খেয়ে থাকলেই চলবে৷ তবে বিশ্বায়ন ছাড়া বিদেশী প্রযুক্তি ব্যবহার করে মুক্তো বানানো অসম্ভব ৷ আপনারা শিল্পদপ্তরে চাপ দিন ৷
ডাইনোসরেরা সকলে মিলে শিল্পদপ্তরে গেল ৷ তারা শুনে চমকে উঠলো, খাদ্য দপ্তরের রাস্তায় পা দেবেন না ৷ সাগর থেকে মাগনা পাওয়া মুক্তো কিনে খেতে খেতে একদিন দেউলিয়া হয়ে যাবেন ৷ তার থেকে কিছু ভালো মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীকে ডেকে আনি ৷ তারা তাদের নব প্রযুক্তির নতুন মেশিন-পত্তর দিয়ে ঝিনুক গুড়িয়ে মুক্তো সাপ্লাই দেবে ৷ ফ্রেশ আর ভেজাল-টেজাল থাকবে না ৷ আর দশটা কোম্পানী এলে কম্পিটিশনে দামও কম থাকবে ৷ আপনারা বিদেশ মন্ত্রকে খোঁজ নিন ৷ কোন বিদেশী কোম্পানী বিনিয়োগ করতে চায় কিনা ?


বিদেশী কোম্পানীগুলো সমুদ্র পারে তাদের অফিস খোলার জন্যে মুখিয়ে ছিল ৷ কাগজে টিভিতে বিজ্ঞাপন দিতে লাগলো কী ভাবে তাদের প্রযুক্তি দিয়ে গুঁড়িয়ে দেবে ঝিনুক ! সরকার ঠিক করলো এবার বিশ্বায়ন করবে ৷ ডাইনোসরেদের কানে গেল সেই কথা ৷ তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলো ৷ বিদেশী কোম্পানী প্রথমে দাঁড়াবে, তারপর বসবে তারপর শুতে চাইবে ৷ আস্তে আস্তে নিজস্ব শিল্প সংস্থা সব লোব পাবে ৷ তখন মুক্তোর বদলে ম্যাকডোনাল্ড চুসতে হবে ৷ সে আরেক বিপদ ৷ তারা সরকারকে লিখিত ভাবে জানালো, বিশ্বায়ন করে সমস্যার নিরসন চাই না ৷ অন্য ভাবে খাদ্য সমস্যা মেটান ৷ সরকার বললো, তাহলে হরলিক্স বা কমপ্ল্যান খান ৷


হরলিক্স, কমপ্ল্যানের বিক্রি খুব বেড়ে গেল ৷ কিন্তু বুড়োরা কিছুদিনের মধ্যেই বিপদ টের পেতে লাগলো ৷ তাদের ছিল খুব সন্দেহ বাতিক ৷ তারা সব কিছুর মধ্যেই বিপদ টের পেত ৷ বুড়োরা কেউ চোঁ চোঁ করে লম্বা হতে লাগলো, কারও স্মৃতিশক্তি খুব বেড়ে যেতে লাগলো ৷ স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে জানানো হলো, তোমরা যখন বিশ্বায়ন করতে দিলে না তখন এরকম ছোট-খাট সমস্যা দেখা দেবেই ৷ ডাইনোসরেরা বললো, এই ভাবে চললে আমাদের গায়েও ডারউইনবাদের হাওয়া লেগে যাবে ৷ আমরা পাল্টে যেতে চাই না ৷ এ রকম চললে ক্রমে ক্রমে আমরা অন্য স্পিসিস হয়ে যাবো ৷ স্বাস্থ্য দপ্তর বললো, হু ৷ তাহলে কোক কোক খাও ৷ পেপসি খাও ৷


অবশেষে বিশ্বায়ন হল ৷ একে একে বিদেশী কোম্পানী আসতে শুরু করলো ৷ ডাইনোসরেরা ক্রমশ পাল্টে যেতে লাগলো ৷ এখন তারা সব কিছু মেনে নিতে শিখেছে ৷ ম্যাকডোনাল্ড, ডগ-বিস্কুট পেপসি খায় ৷ এখন প্রায় মানুষের মতই বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছে ৷ দাঁত পড়লে ডেনটিষ্টের কাছে যায় বটে তবে এখন আর সমস্যা হয় না - মজার ব্যাপার মানুষের দাঁত তাদের দিব্যি ফিট করে যায় ৷ সব চেয়ে বড় কথা তাদের বুড়ো হওয়ার বয়স এখন অনেক বেড়ে গেছে, আসলে সিস্টেমটাই বদলে গেছে কিনা !


প্রথম প্রকাশ : অক্ষর, শারদীয়া সংখ্যা, ১৪০৮

1 comment:

Anonymous said...

বা বেশ ভাল লাগল.